বন্ধুসমাজের মন রক্ষা করিতে গিয়া মেস ছাড়িব ঠিক করিলাম বটে, কিন্তু কথা পাকাপোক্ত করিবার পরপরই মন উতলা হইয়া উঠিলো। নতুন করিয়া হিসাব নিকাষ কষিয়া দেখিলাম, নতুন মেসে যাইবার পিছনে বিবিধ কারণ থাকিলেও, পুরাতন মেসখানি ছাড়িবার পিছনে ছটা কারণও নাই। নতুন মেসের সব গুনাবলি লিস্টি করিতে যাইয়া নতুন মেসের একটা গুরুতর দোষ বাহির হইলো। তাহা হইলো যে, সে আমার পুরাতন মেস নয়। বাচ্চু কাকার কথা ভুল প্রমাণ করিয়া দিয়া দেশ আবেগ দিয়া ভাসায় দিলাম। এটা আমার দ্বিতীয়ঘর, প্রথম মেস – ইহাকে ছাড়িয়া আমি কেমন করিয়া থাকিবো?!
মেইনরোড থেকে একটা সোজা গলি গিয়া পরিয়াছে পুরাতন মেসের প্রধান ফটকের সামনে, গলির দুপাশে বিশ্ববিদ্যালয়ের কামলাখাটা মানুষজনের বসতি। কেউ টঙ্গের দোকানে কাজ করিয়া থাকে, অথবা কেও ডি বিল্ডিঙ্গের নাইটগার্ড। সকালে আমি যখন নাস্তা করিতে বের হই, তখন তারা বাড়ি ফেরে। তাদের সাথে একদিন কথায় কথায় শুনিয়াছিলাম শাহরিয়ার ভাইয়ের গল্প – ভাই সারারাত কাজ করিয়া সকালে নাস্তা করিতে যাইতেন টঙ্গের দোকানে। ভালো মানুষ ছিলেন শাহরিয়ার ভাই, তাদের মুখে এই কথা শুনিয়া ভালো লাগিয়াছিলো। তো মেস ছাড়িবার এই লগ্নে আসিরা হটাথ করিয়া খালার অতিরিক্ত পেয়াজ দেয়া চাউমেইন ও সুস্বাদু লাগিলো। বাড়িওয়ালা আন্টির রান্না এম্নিতেই ভালো, সামনের রোজায় তার ইফতারির খুব অভাব বোধ হইবে। এগারোটাকার মারলবোরোটায় মাত্র ধরায় একটা টান দেয়া হইসে, এমন সময় দেখি আঙ্কেল এ বিল্ডিং এর দিক হইতে হন্তদন্ত হইয়া যাত্রীছাউনির দিকে ছুটিয়া আসিতেসেন। ঘর হইতে আরাইশো কিলো দূরে আসিয়াও যে কাউকে দেখিয়া সিগারেট ফালাই দিতে হবে সেই চিন্তা একদম মাথায় ছিলো না।
সিলেটে আমার পরিবার বলতে এই মেসটাই যা ছিলো। পরিবারের সবাইকে কথাটা কিভাবে জানাবো তা ঠিক করার আগেই তাহাদের থেকে প্রস্তাব পাইলাম, তাহারা তাদের ডিপার্টমেন্টের মানুষ ঠিক করিয়াছে আমার সিটে তোলার জন্য। আমার চলে যাওয়ার ব্যাপারে তাদেরকে খুব একটা বিচলিত মনে হইলো না। এতে আমারই সুবিধা, চলে যাওয়াটা সহজ হবে, কিন্তু অযথাই আমার রক্ত গরম হইলো। শুয়ারের বাচ্চাগুলার তলপেটে লাত্থি মারার প্রবল ইচ্ছাকে সংবরন করিয়া লইলাম। এইখানে প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, আমাদের মেস এখন আর ফ্ল্যাট সিস্টেমের নাই। অর্থাৎ আগে আমরা মেসে কয়জন থাকি তা গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না, মাসশেষে আঙ্কেল্কে বুঝে বুঝে দশহাজার টাকা দিয়ে দিতে হত। আঙ্কেল একদিন ঠিক করিলো কে যায় কে থাকে ব্যাপার না, আমাদের এখন থেকে আমাদের সিটের ভাড়া দিলেই চলবে। মনুষ্য প্রজাতির কাছ থেকে আমার প্রত্যাশা অনেক কম, তবুও এরকম একটা মুহূর্তে দ্বিতীয় পরিবারের এহেন ব্যবহারে খুবই ব্যাথিত হইলাম।
যাই হোক, মেসে গবাদি পশু ব্যাতিরেকে আরো কিছু জিনিস ছিলো অভাব বোধ করিবার মত। অনেকদিন মেসের ছাদে উঠা হয়না। কলের পান্থ কানাই এর কথা খুব মনে ধরিয়াছিলো। সামনের মাসে একটা গিটার কিনিয়া এই ছাদে বসিয়া টুংটাং করিবার কথা ছিলো। কিন্তু সেই কথা ধরিয়া বসিয়া থাকিলে হইবেক না। অইদিকে শিরোনামহীন বলেছে, “কিছু কথা কখনো হারিয়ে যায়”
দ্বিতীয় বর্ষের চূড়ান্ত পরিক্ষার বাহানা দিয়া দফা কিছুটা পিছানো গেলো। তবে সেই লগ্ন ক্রমশই নিকট হইয়া আসিতেছে। আসুক, দিনে দিনে সময় কম হয় নাই।